সারা দুনিয়া জুড়ে টেকনোলজির ঢেউ। আর প্রযুক্তির এই ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে উঠে আসছে অত্যন্ত দ্রুত। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ডিজিটাল রূপান্তরের অসাধারণ এই যাত্রায় আমাদের দেশটি নজর কাড়ছে সমগ্র পৃথিবীর। একসময় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি হলেও বাংলাদেশ আজ দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা ডিজিটালাইজেশনকে গ্রহণ করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে করেছে আরও সহজ আর সবার কাছেই বিস্তৃত—শহর, নগর, বন্দর সর্বত্র। আমাদের দেশের অনেকগুলো প্রযুক্তির আশীর্বাদের একটি হলো ফিনটেক।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ

১৯৭১-এর যুদ্ধ পরবর্তী আমাদের দেশটা দরিদ্রতম দেশ থেকে মধ্যম আয়ে পৌঁছেছে। ১৭ কোটি ৪০ লক্ষাধিক মানুষের আবাসভূমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। সেটা কি একদিনে? না, বরং ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সঠিক সময়ের উদ্যোগেরই মাধ্যমে এটা সম্ভব হয়েছে।

ডিজিটাল রূপান্তরের অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রভাব হলো মোবাইল ইন্টারনেটের বিস্তার। ২০১৭ সালে যেখানে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ মানুষের মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ ছিল, সেখানে ২০২১ সালের মধ্যে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সর্বজনীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, যাদের ৬০ শতাংশেরও বেশি ৩৫ বছরের নিচে, এই ডিজিটাল রূপান্তরের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।

ফিনটেক: আর্থিক সেবায় প্রবেশের নতুন দরজা

আর এই ইন্টারনেটের বিস্তারের মাধ্যমেই ফিনটেক বা অনলাইন ব্যাংকিং-এর সুবিধা এসেছে। এসেছে গ্রামে-গঞ্জে, সমতল কিংবা পাহাড়ে—সর্বত্রই একটা দারুণ আর্থিক সুবিধা। ডিজিটালাইজেশনের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ ২০২১-২০২৬ মেয়াদের জন্য প্রথম জাতীয় আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল প্রণয়ন করে। এরপর থেকে financial inclusion উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্ত, যেখানে আগে এ হার ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ।

তবে এই অগ্রগতির পরও, এখনো মাত্র ৩৮ শতাংশ জনগণের প্রথাগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়ে গেছে। ডেবিট কার্ড ব্যবহার এখনো এক-তৃতীয়াংশের নিচে; এর থেকেও কম ব্যবহার দেখা যায় প্রতিনিধি ব্যাংকিংয়ে (৭ শতাংশ), ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে (৬ শতাংশ), প্রিপেইড কার্ডে (৩ শতাংশ), এবং ক্রেডিট কার্ডে (মাত্র ২ শতাংশ)।

মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস: গেম চেঞ্জার

মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (MFS)-এর বিস্তারের মাধ্যমেই বাংলাদেশের ফিনটেক উন্নয়নে বড় লাফ দিয়েছে। মূলত ব্যাংকগুলোর নেতৃত্বে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের (দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক) সহায়তায় MFS-এর এই প্রবৃদ্ধি এসেছে, যা ডিজিটাল ফাইন্যান্স ও উদ্ভাবনকে এগিয়ে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল ২০১৯ সালে ‘Regulatory Fintech Facilitation Office (RFFO)’ প্রতিষ্ঠা, যা আর্থিক খাতের উদ্ভাবকদের আকর্ষণ এবং জনগণের আর্থিক সেবায় প্রবেশাধিকার বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে।

সাধারণ মানুষের জীবনে ফিনটেকের প্রভাব

বর্তমানে ফিনটেক ব্যবহারের মধ্যে কেমন সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে সেটা একটু জানা যাক—

আগে যেখানে ব্যাংকিং সেবা নিতে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হতো, এখন মোবাইল ফোনে কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমেই লেনদেন সম্পন্ন হচ্ছে। টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধ, এমনকি ক্ষুদ্র সঞ্চয়, সবকিছুই আজ হাতের মুঠোয়।

গ্রামের মানুষও আজ ডিজিটাল আর্থিক সেবার সুফল পাচ্ছে। কৃষকরা সহজেই মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের পণ্যের মূল্য পাচ্ছেন। দিনমজুর কিংবা প্রবাসী কর্মীর পাঠানো টাকা মুহূর্তেই পরিবারের হাতে পৌঁছাচ্ছে। ফলে সময় বাঁচছে, খরচ কমছে এবং নিরাপত্তা বাড়ছে।

নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ফিনটেক এক বিশাল সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে বসেই তারা ব্যবসার লেনদেন সম্পন্ন করতে পারছেন। এটি শুধু অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছে না, বরং নারীর ক্ষমতায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ফিনটেক সেবা পৌঁছে গেছে। এর মাধ্যমে যারা আগে কখনো ব্যাংকের সেবা পাননি, তারাও এখন ডিজিটাল ফাইন্যান্স ব্যবহার করতে পারছেন।

মুদি দোকানিদের গল্প: ফিনটেকের আরেক মাত্রা

এতো গেল সাধারণ মানুষের জীবনে ফিনটেক-এর প্রভাব। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড—মুদি দোকানিরা—কীভাবে এই ডিজিটাল বিপ্লব থেকে লাভবান হচ্ছেন?

বাস্তবতা হলো, সব মুদি দোকানি কিন্তু সমানভাবে ফিনটেক-এর সুবিধা পাচ্ছেন না। যারা PriyoShop-এর মতো প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত, তারাই এই সুবিধা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করছেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, বিশেষ করে মুদি দোকান। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তারা মূলধন সংকট, লেনদেনের ঝামেলা এবং ব্যাংকিং সেবার অভাবে পিছিয়ে ছিল। ঠিক এখানেই PriyoShop-এর ফিনটেক সমাধান মুদি দোকানিদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।

সহজ লেনদেন ও ডিজিটাল পেমেন্ট

PriyoShop-এর ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে মুদি দোকানিরা এখন সহজেই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন, ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন, এমনকি প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটালও পেয়ে থাকেন। ফলে দোকানের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানো আরও সহজ ও স্বচ্ছ হচ্ছে।

ঝামেলাহীন ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা

আগে যেখানে ব্যাংক লোন পাওয়া মুদি দোকানিদের জন্য ছিল প্রায় অসম্ভব, এখন PriyoShop তাদের ব্যবসার লেনদেনের ইতিহাস দেখে ঝামেলাহীন ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। এর ফলে দোকানিরা পণ্য মজুদ বাড়াতে পারছেন এবং হঠাৎ অর্থসংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন।

নিরাপদ লেনদেন ও শক্তিশালী ক্যাশ ফ্লো

ডিজিটাল পেমেন্ট সল্যুশনের কারণে দোকানিরা আর নগদ টাকার ঝুঁকিতে থাকছেন না। গ্রাহকরা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা QR পেমেন্টের মাধ্যমে সহজে টাকা দিতে পারছেন। এতে দোকানের ক্যাশ ফ্লো শক্তিশালী হচ্ছে এবং হিসাব রাখা হচ্ছে আরও সঠিকভাবে।


আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাস্তব উদাহরণ

সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এই ফিনটেক সমাধান মুদি দোকানিদের ব্যাংকিং সেবায় নিয়ে আসছে। যারা আগে কখনো ব্যাংকিং সুবিধা পাননি, তারাও এখন আধুনিক ডিজিটাল ফাইন্যান্স ব্যবহার করতে পারছেন, যা তাদের ব্যবসাকে করছে আরও লাভজনক ও টেকসই।

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশে ফিনটেক এখন শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য এক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। মোবাইল ইন্টারনেটের বিস্তার, তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় ভূমিকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্ভাবনী পদক্ষেপ—সবকিছু মিলে আজ দেশের সর্বস্তরের মানুষ ফিনটেকের সুবিধা পাচ্ছে।

কৃষক থেকে প্রবাসী শ্রমিক, নারী উদ্যোক্তা থেকে তরুণ স্টার্টআপ, সবার জন্যই ডিজিটাল ফাইন্যান্স এনেছে নতুন সম্ভাবনা। বিশেষ করে মুদি দোকানিরা, যারা একসময় মূলধনের অভাব, নগদ টাকার ঝুঁকি আর ব্যাংকিং জটিলতায় ভুগতেন, তারা এখন PriyoShop-এর ফিনটেক সল্যুশনের মাধ্যমে পাচ্ছেন সহজ ঋণ, নিরাপদ লেনদেন আর উন্নত ব্যবসা করার সুযোগ।

এমন সুবিধাগুলো কেবল তাদের দোকান পরিচালনার ধরন পরিবর্তন করছে না, বরং তাদের ব্যবসাকে আরও টেকসই ও লাভজনক করে তুলছে। PriyoShop নিরন্তর দেখিয়ে দিচ্ছে, প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ হলে ক্ষুদ্র ব্যবসাও হতে পারে অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি।

ভবিষ্যতে ফিনটেকের পরিধি আরও বিস্তৃত হবে, আরও বেশি মানুষ ডিজিটাল ফাইন্যান্সে যুক্ত হবে, এবং বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে financial inclusion নিশ্চিত হবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল অর্থনীতি যেখানে প্রতিটি মুদি দোকান, প্রতিটি ক্ষুদ্র ব্যবসা হবে আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান এবং প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ। এভাবেই ফিনটেক সেবা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *